পিপি ডেস্ক: এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও দেশে তথ্য কমিশন পুনর্গঠন করেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধান তথ্য কমিশনার, দুই কমিশনার ও সচিব নিয়োগ না হওয়ায় দৈনন্দিন কাজ চালানোর জন্যও অর্থ খরচ করতে পারছে না কমিশন। নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে অসংখ্য অভিযোগ।
গত বছর জুলাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদলের পর ৫ সেপ্টেম্বর প্রধান তথ্য কমিশনার আবদুল মালেক ও তথ্য কমিশনার শহীদুল আলম ঝিনুক পদত্যাগ করেন। চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি তথ্য কমিশনার মাসুদা ভাট্টিকে অপসারণ করা হয়। ৩ সেপ্টেম্বর তথ্য কমিশনের সচিব জুবাইদা নাসরীনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে তথ্য কমিশনের শীর্ষ পদগুলো শূন্য। এদিকে তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে দেশের ৭৫ শতাংশ মানুষ জানে না। ২৫ শতাংশ মানুষ এ সম্পর্কে জানলেও তাদের মধ্যে ২০ শতাংশের এ বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
তারই মধ্যে আজ রবিবার আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘পরিবেশ রক্ষায় ডিজিটাল যুগে তথ্যের অধিকার নিশ্চিতকরণ’। তথ্য অধিকার সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি বছরের মতো এ দিন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিবসটি উদযাপন করা হবে। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঢাকাসহ দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সরকারি এক তথ্যবিবরণীতে জানানো হয়েছে, কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় এবং জেলা পর্যায়ে পৃথক পৃথক আলোচনাসভা। এছাড়া দিবসটির প্রতিপাদ্য অনুসরণ করে মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে প্রচার, জনগণের তথ্য অধিকারবিষয়ক বিভিন্ন ডকুমেন্টারি ডিজিটাল স্ক্রল ও ডিজিটাল অ্যাডভারটাইজিং বোর্ডে প্রচার, ওয়েবসাইটে দিবস উদযাপনের ফেস্টুন প্রচার ইত্যাদি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে আজ বিকাল ৩টায় তথ্য কমিশন বাংলাদেশের অডিটোরিয়ামে এক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম প্রধান অতিথি থাকবেন। সভায় বিশেষ অতিথি থাকবেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবা ফারজানা। এতে আলোচক থাকবেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. ফাহমিদা খানম। এদিকে তথ্যবিবরণীতে সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলসহ সব ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দিবসটির প্রতিপাদ্য—‘পরিবেশ রক্ষায় ডিজিটাল যুগে তথ্যের অধিকার নিশ্চিতকরণ’ বার্তাটি স্ক্রল আকারে প্রচারের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
কমিশন না থাকায় কোনো অভিযোগের শুনানি হচ্ছে না: সূত্র জানায়, তথ্য কমিশনের ৭৪টি পদের বিপরীতে এক জন পরিচালক ও এক জন একান্ত সচিব প্রেষণে এবং ২৭ জন স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ২০ জন আউটসোর্সিংসহ মোট ৪৯ জনবল আছে। কমিশন গঠন না হওয়ায় বর্তমানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজ হচ্ছে প্রতিদিন অফিসে আসা। কমিশনের এক জন কর্মকর্তা বলেন, কমিশন না থাকায় কোনো অভিযোগের শুনানি হচ্ছে না। প্রতিদিন নতুন অভিযোগ জমা হচ্ছে। তিনি বলেন, তথ্য কমিশনের পরিচালকের আর্থিক ক্ষমতা না থাকায় কমিশনের অর্থসংশ্লিষ্ট সব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এক টাকা খরচ করারও উপায় নেই। কমিশনের কর্মকর্তারা দুটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। টাকার জোগান না থাকায় একটি গাড়ি বাদ দিয়ে কর্মকর্তারা নিজেরা চাঁদা দিয়ে একটি গাড়ি ব্যবহার করছেন।
১৫ বছরে তথ্য কমিশনে ৫২৭১ অভিযোগ নিষ্পত্তি: গত ১৫ বছরে তথ্য কমিশনে মোট ৫ হাজার ৩৬০টি অভিযোগের মধ্যে ৫ হাজার ২৭১টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৮০টি অভিযোগের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তথ্য কমিশন এ পর্যন্ত সর্বমোট ৫৫ হাজার ২২৪ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
তথ্য কমিশন শূন্যতায় ‘সরকারের অবহেলা’ দেখছে টিআইবি : এক বছর ধরে অকার্যকর তথ্য কমিশন ও মানবাধিকার কমিশন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি। সংস্থাটি বলেছে, ‘এই দুই প্রতিষ্ঠানের শূন্যতা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের প্রতি সরকারের অবহেলার একটি ‘অগ্রহণযোগ্য’ উদাহরণ। সরকারের জন্য এটি ‘বিব্রতকর রেকর্ড’ হয়েছে। গত ২৩ জুলাই সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তথ্য কমিশন ও মানবাধিকার কমিশন গঠন সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও মানবাধিকারের প্রতি রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতির গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। অথচ দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পার হয়ে গেলেও কমিশন দুটি গঠনে কোনো কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। কেন দীর্ঘকাল যাবত তা গঠিত হচ্ছে না, তার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যাও নেই।’
শিগগিরই জারি হবে তথ্য কমিশন গঠনের প্রজ্ঞাপন: তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় : এদিকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় গত ২৬ জুলাই এক তথ্য বিবরণীতে বলেছে, তথ্য কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। শিগগিরই এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে। ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী এক জন প্রধান তথ্য কমিশনার এবং দুই জন তথ্য কমিশনার নিয়ে এ কমিশন গঠিত হবে। দুই জন তথ্য কমিশনারের মধ্যে ন্যূনতম এক জন হবেন নারী।
যেভাবে গঠন হয় তথ্য কমিশন আইন: গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে ২০০৮ সালে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নাগরিকদের তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তথ্য অধিকার অধ্যাদেশ, ২০০৮ জারি করা হয়। অধ্যাদেশটি বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীজনদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে প্রণীত হয়। নির্বাচনের পর নবম জাতীয় সংসদ অধ্যাদেশটি অনুমোদন করে। ব্যাপক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে প্রণীত হওয়ায় এটি একটি শক্তিশালী আইন হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিও পেয়েছে। কানাডাভিত্তিক সংগঠন ‘সেন্টার ফর ল অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’র মূল্যায়ন অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশের আইনটি বিশ্বের ২০টি শক্তিশালী আইনের মধ্যে একটি।’ এদিকে আইনের ১৩ ধারা অনুযায়ী তথ্য কমিশনের উদ্দেশ্য হলো, মূলত তথ্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের অভিযোগ নিষ্পন্ন করা। এছাড়া আইনে তথ্য কমিশনকে স্বপ্রণোদিত হয়ে অথবা কোনো অভিযোগের ভিত্তিতে উত্থাপিত বিষয় সম্পর্কে অনুসন্ধান করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ২০০৯ সালে আইনটি সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হলেও গত ১৫ বছরে নাগরিকরা এর সুফল পাওয়া থেকে ব্যাপকভাবে বঞ্চিত ছিল। বিরাজমান তথ্য গোপন করে রাখার সংস্কৃতিতেও কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। এ পরিস্থিতির পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তবে একটি বড় কারণ দলীয় অনুগত ব্যক্তিদের নিয়ে সরকারের আজ্ঞাবহ একটি তথ্য কমিশন গঠন, যে কমিশনের সদস্যরা নাগরিকের তথ্য পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের খুশি করার, অন্তত নাখোশ না করার ব্যাপারেই যেন বেশি আগ্রহী ছিল।
পার্লামেন্ট প্রতিদিন/ এমআর