আমেনা বেগম: কমনওয়েলথ ওয়ার সিমেট্রি কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশনের (সিডব্লিউজিসি) একটি সৌধ। এটা সাধারণত চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি নামে পরিচিত। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বাংলোর সামনেই ১৯ নম্বর বাদশা মিয়া সড়কে এ ওয়ার সিমেট্রির অবস্থান। ওয়ার সিমেট্রির পাশেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশিষ্ট সুফি সাধক বদনা শাহ(রহ.) এর মাজার অবস্থিত।
দুই বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করা রাজকীয় ব্রিটিশ ফোর্সের প্রায় ১৭ লাখ নিহত সদস্যের স্মৃতি রক্ষার্থে গড়ে ওঠা এ সংগঠন ১৫০টি দেশে প্রায় ২৩ হাজার স্থানে সমাধি ও স্মৃতিসৌধ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত। কমিশন নিহত প্রতিটি সদস্যের তথ্য সংরক্ষণ করে, যা তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনলাইনে দেখা যায়। স্যার ফেবিয়ান ওয়্যার নামে ব্রিটিশ রেড ক্রসের এক কর্মকর্তার নিরলস চেষ্টার ফসল এ কমিশন। বাংলাদেশে তিনটি সমাধি পরিচালনা করে। এগুলো কুমিল্লার ময়নামতি, চট্টগ্রামের বাদশা মিয়া রোড় ও নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে অবস্থিত।
বাদশা মিয়া রোডে ফিনলে গেস্ট হাউজের প্রাচীরঘেঁষে সিমেট্রি গেটে পৌঁছে, ৩-৪ মিনিট হেঁটে গ্রিলঘেরা সবুজ চত্বর অতিক্রম করে সমাধিস্থলের মূল ফটক। প্রবেশ পথের পাশেই বোর্ডে পরিষ্কার করে করণীয় ও বর্জনীয় কার্যাবলির তালিকা দেয়া আছে, যেন এ সমাধিক্ষেত্রের পবিত্রতা রক্ষা করা যায়। যে কেউ বিনা টিকিটে সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা এবং দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সমাধিক্ষেত্রটি ঘুরে দেখতে পারেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী দামপাড়ার কাছে নির্জন এলাকায় এ সিমেট্রি তৈরি করে। প্রাথমিকভাবে ৪০০ সদস্যের সমাধি নিয়ে শুরু সিমেট্রিতে সমাধির সংখ্যা পরবর্তী সময়ে ৭৫৫-তে পৌঁছে। কারণ চন্দ্রঘোনা, চিরিঙ্গা, দোহাজারী, কক্সবাজার, যশোর, খুলনা, ঢাকা এমনকি আসাম থেকে এখানে সমাধি স্থানান্তরিত হয়। ইউনিট আর পদবির ব্যবধান ঘুচিয়ে একই আকার, আকৃতির সমাধিফলকে উত্কীর্ণ রয়েছে প্রত্যেকের নাম, রেজিমেন্ট আর দেশের নাম। পরবর্তী সময়ে কিছু কিছু সমাধিফলকে নিহত সদস্যের পরিবারের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে পবিত্র কোরআনের আয়াত, বাইবেল থেকে নেয়া বাণী অথবা প্রিয় কবিতার পঙিক্তমালা সংযুক্ত করা হয়েছে। এখানে সমাধিফলকে ৭১৫ জনকে চিহ্নিত করা আছে, বাকিদের পরিচয় জানা যায়নি।
চারপাশে বড় বড় গাছে ঘেরা এ সুনসান সমাধিস্থলের প্রবেশপথ থেকে শেষের প্রার্থনা ঘর পর্যন্ত দুদিকে সারি সারি সমাধিফলকে ৫২৪ সৈনিক, ১৯৮ বৈমানিক আর ১৩ জন নাবিকের শেষ চিহ্ন রয়েছে। নিহতদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৭৮ জন যুক্তরাজ্যের নাগরিক, ২১৪ জন অবিভক্ত ভারতের ও ৯০ জন পশ্চিম আফ্রিকার। এছাড়া এখানে কানাডা, পূর্ব আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিলান্ডসহ অন্যান্য দেশের নাগরিক রয়েছেন। প্রবেশ পথের ডান পাশে ছোট একটি কক্ষে সংরক্ষিত রেজিস্টারে ১৯৩৯-৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সাগরে মৃত্যুবরণ করা নাবিক ও লস্করদের নাম রয়েছে।
দেশের সেবায় সলিল সমাধি বরণ করে নেয়া ইন্ডিয়ান রয়্যাল নেভি ও ইন্ডিয়ান মার্চেন্ট নেভির প্রায় ৬ হাজার ৫০০ সদস্যের স্মরণে ‘চিটাগং/বোম্বে ১৯৩৯-১৯৪৫ ওয়ার মেমোরিয়ালস’ নামের দুটি রেজিস্টারের অন্য কপিটি ভারতের মুম্বাইয়ে অবস্থিত ইন্ডিয়ান সিম্যান হোমে রক্ষিত আছে।
কোনো রকম বসার জায়গা, খাবারের ব্যবস্থা, হকার ও ভিক্ষুকবিহীন, ডিএসএলআর ক্যামেরামুক্ত পরিবেশে মনকে স্থির করে শুধু নিহতদের শ্রদ্ধা জানাতে আগ্রহী হলেই আপনার যাওয়া উচিত সিডব্লিউজিসির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ সমাধিক্ষেত্রে।
এই সমাধিক্ষেত্রটি রক্ষাবেক্ষণের জন্য চার জন কর্মচারী আছে এবং একজন ডাইরেক্ট আছে। তাদরে বেতন ভাতা কমনওয়েলথ থেকে দেওয়া হয়্ প্রতি বছর আগষ্ট ও ডিসেম্বরে তাদের স্মরণে এখানে অনুষ্ঠান করা হয়। সতেরটি দেশের রাষ্ট্রদূতের এই অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান ও চট্টগ্রামের জিওসি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকে। বিট্রিশ হাই কমিশন থেকে অফিসারেরা প্রায় সময় এখানে বলে জানা যায়।
পিপি/ আরটি