পিপি ডেস্ক: চার দিকে অথই জল। তাতে ভাসছে সবুজ কচুরিপানা আর সাদা শাপলা। কাচ স্বচ্ছ পানির নিচে হাজারো জলজ উদ্ভিদ। সামনে তাকালেই নজরে পড়ে উড়ন্ত বা ডুব সাঁতার খেলা বক, কালিম, বালি হাঁস, পানকৌড়ি, শামুকখোলসহ নানা পাখির ঝাঁক। শীতে অতিথি পাখির মেলা বসে। কলকাকলিতে ভরে ওঠে চারিদিক। সৌন্দর্যের ডালা বিছানো এ জলাশয়ের নাম গরিলা বিল। বিশালকায় সেই বিলের মাঝে অনেক উঁচু এক খণ্ড ভূমি; যা সবুজ গাছপালায় ঢাকা-নাম ‘যোগীর গোপা’ বা ‘যোগী দ্বীপ’।
যোগী দ্বীপ টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল ইউনিয়নের মোহাইল ও কাহেতা মৌজার একটি ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান। হিন্দু সম্প্রদায় একে পূণ্যস্থান গণ্য করেন। ময়মনসিংহ ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারে বলা হয়, সুলতানি আমলে হিন্দু সন্ন্যাসী বা যোগীরা এ নির্জন দ্বীপে গোপন সাধনায় বা ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। এ জন্য নামকরণ হয় ‘যোগীর গোপা’ বা ‘যোগীর গোপন স্থান’। এটি যোগী দ্বীপ নামেও পরিচিত। তবে কবে, কখন, কীভাবে এ দ্বীপের সৃষ্টি তা কেউ বলতে পারেন না।
বিলের দক্ষিণে দেড় কিলো দূরে ১৮৯০ সালে নির্মিত হয় হেমনগর রাজবাড়ী। জমিদার হেমচন্দ চৌধুরীর পুত্র হেরম্ভ চৌধুরী ১৯৩০ সালে ময়মনসিংহ ডিস্ট্রিক রেভ্যুনিউ অফিসারকে এক পত্রে যোগীর গোপা বা যোগী দ্বীপের পাঁচ একর জায়গা নিষ্কর ভূমি করার আবেদন জানান। আবেদনে বলা হয়, এটি ঐতিহাসিক ও পবিত্র স্থান। একে ঘিরে নানা প্রবাদ ও উপাখ্যান বিদ্যমান। জমিদার হিসাবে তিনি এটি সংরক্ষণ করতে চান।
দেশ ভাগের পর হেমনগর জমিদাররা কোলকাতায় পাড়ি জমালে প্রভাবশালীরা নানা ছুঁতায় যোগী দ্বীপের জায়গা জবরদখলে নিতে থাকে। এখন বড় জোর ১২/১৩ শতাংশে জমিতে পাহাড় সমান উচ্চতা নিয়ে দ্বীপটি কোনভাবে টিকে আছে। এক দশক আগেও বর্ষাকালে পর্যটক ও বিনোদনপিয়াসিরা এখানে নৌকা ভ্রমণে আসতেন। সবুজ গাছপালায় ঢাকা নির্জন দ্বীপে সুন্দর সময় কাটাতেন। ঝাওয়াইল ইউনিয়ন পরিষদের আর্থিক সহায়তায় এখানে আধা পাকা ভবন, বসার জায়গা ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়।
কাহেতা গ্রামের নজরুল ইসলাম জানান, চারদিকে জল থাকায় বছরের দশ মাস নৌকা ছাড়া সেখানে যাওয়া যায় না। জীন বা প্রেতাত্মার আনাগোনার অজুহাত দেখিয়ে দর্শনীয় স্থানটি
সংঘবদ্ধ চক্র জবরদখলে নিয়েছে। সেখানে নিয়মিত জুয়ার আসর ও মাদকের হাট বসে। পলাতক ও ফেরারি আসামিরা নিরাপদে আশ্রয় নেয়।
সাবেক ইউপি সদস্য আবদুল হামিদ জানান, প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে মাদকের হাট বসে। কোটি টাকার মাদক বিক্রি হয়। সেদিন বহু নেশাখোরের আগমন ঘটে। সিংহভাগই তরুণ। পৃথক তিনটি নৌকায় তাদের পারাপার করা হয়। সেদিন ডেকচিতে খিচুড়ি রান্না ও ভোজ হয়। মোহাইল গ্রামের কলেজ ছাত্র শামীম হোসেন জানান, যোগী দ্বীপটি এখন দুষ্কৃতকারী মাদক ব্যবসায়ী এবং নেশাখোরের অভয়ারণ্য।
এক কিলো দূরে হেমনগর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র। সেখানে লিখিত অভিযোগ দিয়ে ও প্রতিকার মেলেনি। দ্বীপের মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এলাকায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে। প্রতিদিনই গৃহস্তের ছাগল-গরুসহ বাড়িঘরে চুরি যাচ্ছে। বিলের পশ্চিম অংশ দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইনের স্লিপারের পাত আটকানোর ক্লিপ চুরি যাচ্ছে। ফলে জামালপুর-ভূঞাপুর যমুনা সেতু রেলস্টেশনে যাতায়াতকারি ট্রেন ঝুঁকি নিয়ে চলছে।
ঝাওয়াইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, প্রভাবশালীরা ঐতিহাসিক ও বিনোদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ স্থান বেদখলে নিয়েছে। মাদকব্যবসার নিরাপদ জোন বানিয়েছে। একটি প্রজন্ম ধ্বংস করছে। স্থানটি আদিরূপে ফেরানোর জন্য প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ দাবি করেন তিনি। হেমনগর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এসআই রমজান আলী জানান, এখানে তিনি নতুন এসেছেন। যোগীর গোপার মাদক ব্যবসা সম্পর্কে অবগত নন। তবে খোজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
পার্লামেন্ট প্রতিদিন/ এমআর