চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ও একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক বন্দরনগরী। পাহাড়, খাল, নদী ও সমুদ্র ঘেরা এই নগরী একসময় ছিল প্রাকৃতিকভাবে সুসংঘবদ্ধ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অধিকারী। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রম, খাল দখল, আবর্জনা ফেলা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বর্তমানে চট্টগ্রাম মারাত্মক জলাবদ্ধতার সমস্যায় ভুগছে। একসময় এই নগরীতে খালের সংখ্যা ছিল ১০৪টি। অবৈধ দখলদারের কবলে পড়ে ভরাট হতে হতে খালের সংখ্যা কমে হয়েছে ৩৬। হারিয়ে গেছে বাকি ৬৮টি খাল।
জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে চট্টগ্রামের খাল ও নালাগুলোর সংস্কার, পুনঃখনন ও নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) হিসাব অনুযায়ী-নগরের ৪১ ওয়ার্ডে খাল-নালার দৈর্ঘ্য প্রায় ১,১৩৭ কিলোমিটার। নিরাপত্তা বেষ্টনি ছাড়া খালের পাড় রয়েছে ১৯ হাজার ২৩৪ মিটার। উন্মুক্ত নালার সংখ্যা ৫ হাজার ৫২৭টি, যেগুলোর বেশির ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ।
চসিক ২০২১ সালে এসব স্থানের একটি তালিকা প্রস্তুত করলেও সমস্যা সমাধানে আজও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সমপ্রতি খালে পড়ে একটি শিশুর মৃত্যুর পর ৫৬৩টি ঝুঁকিপূর্ণ স্পটকে চিহ্নিত করে চসিক সাময়িকভাবে বাঁশ ও লাল ফিতা দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করেছে। এসব স্পটে ৮৬৩টি স্ল্যাব ও ১৪৬টি স্থায়ী বেষ্টনী প্রয়োজন।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কবি ওমর কায়সার বলেন, চট্টগ্রাম শহরের আনাচে-কানাচে একসময় প্রাণবন্ত স্রোতোধারা নিয়ে বহু খাল ও ছড়ার অস্তিত্ব ছিল। এসবে নৌযানের চলাচল ছিল। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাছে নগরের ৫৭টি খালের তালিকা রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই এখন নালায় পরিণত হয়েছে। নগরীর প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, সিটি করপোরেশনের তালিকাভুক্ত ৫৭টি খালের বাইরে আরো অনেক খাল ছিল। আরাকান সড়কসহ চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় কিছু ছোট ছড়া দখল ও ভরাটের কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এসব খাল।
অন্যদিকে বাণিজ্যকেন্দ্র খাতুনগঞ্জ এলাকায় প্রবাহিত মধ্যম বদরখালী খালটি দখলদারদের কবলে পড়ে দুই-তিন ফুটের নালায় পরিণত হয়েছে। এটি বক্সিরহাট এলাকা হয়ে ওসমানিয়া গলির পাশ দিয়ে চাক্তাই খালে মিশেছে, সেখানে খালটি বর্তমানে ৩০ ফুট প্রস্থ। ১৯ নম্বর দক্ষিণ বাকলিয়া মিয়া খাননগর ম্যাচ ফ্যাক্টরি পাশ দিয়ে একসময় ৫০ থেকে ৮০ ফুট প্রস্থ চাক্তাই-বির্জা সংযোগ খালটি বর্তমানে ২ থেকে ৩ ফুটের নালায় পরিণত হয়েছে। অথচ এই করুণ অবস্থা একসময় ছিল না।
ওমর কায়সার আরো বলেন, একটা সময় ছিল, যখন চট্টগ্রামের প্রধান ভরসা ছিল জলপথ। এখানে রাস্তাঘাট বানানো শুরু হয় ১৮৬০ সাল থেকে। তার ৩০ বছর আগে, অর্থাত্ ১৮৩০ সালে নৌপথে কলকাতা থেকে ক্যাপ্টেন পগসন নামের এক সরকারি কর্মকর্তা একটি তদন্তকাজে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। তার লেখা ‘ট্যুর টু চাটিগাঁও’-এ জলপথনির্ভর চট্টগ্রামের যোগাযোগব্যবস্থার কথা উল্লেখ রয়েছে।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল বোয়ালখালী, পটিয়া, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, মহেশখালী, নোয়াখালীর হাতিয়া, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থেকে যাত্রী ও পণ্যবোঝাই সাম্পান ভিড়ত চাক্তাই ও রাজাখালী খালে। আশির দশকের শেষ পর্যন্ত দুটি খালে বড় বড় পাল তোলা পণ্যবাহী নৌকা, লঞ্চ, স্পিডবোট চলতে দেখেছি আমরা। সত্তর থেকে আশির দশকে চাক্তাই খালে শুশুকের ঝাঁপাঝাঁপি দেখে আনন্দে মেতে থাকত খালপারের শিশু-কিশোরেরা। এই জলাবদ্ধ নগরে ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি নালার পাশে দাঁড়িয়ে সেসব স্মৃতি আমাদের অতীতাকুল করে।
ওমর কায়সার বলেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ইতিহাস থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম পৌরসভা গঠনের (১৮৬৩ সাল) সাত বছর আগে ১৮৫৬ সালের ১৪ মে তত্কালীন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে একটি প্রস্তুতি সভা হয়। সেই প্রাক পৌরসভার প্রস্তুতি সভার পর ১৬৯ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো এলাকাভিত্তিক ভূমির উচ্চতা নির্ধারিত হয়নি, হয়নি পানি নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা।
চট্টগ্রাম শহরকে সঠিকভাবে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে শুধু চলমান কাজগুলো শেষ করলে হবে না। আরো ২১টি খাল, উপখালসহ পাহাড়ি ছড়া খননের প্রয়োজন হবে। এর জন্য মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়া দরকার।
পার্লামেন্ট প্রতিদিন/ এমআর