মামুন রশীদ
পতিত সরকারের শেষ বছরগুলোতে বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়াটি অনেকটা খেলো হয়ে যায়, যেন আমলাদের জন্য একটা ‘ফরম ফিল আপ এক্সারসাইজ’। বাজেট ঘাটতি, সামাজিক সুরক্ষা, রাজস্ব আদায় পরিকল্পনা, এমনকি প্রকল্প প্রাধিকার নির্ণায়নেও অনেকটা ‘অর্ডিনারি’ বা আটপৌরে বৃত্তায়ন গড়ে ওঠে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটেও জনগণের স্বার্থ, এমনকি ভবিষ্যতের অর্থনীতি বিনির্মাণের বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়। বরং দেশের অলিগার্ক গোষ্ঠী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের স্বার্থ বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটেছে। দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন। অথচ এখনো ২০২৪-২৫ অর্থবছরের কর, শুল্ক ও ব্যয় কাঠামো একই আছে।
তবে বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগটি রহিত করা হয়েছে। আমরা জানি, গেল কয়েক বছরে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে আনুপাতিক হারে কমেছে বরাদ্দ। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয়ের আবার বড় অংশই যায় পেনশনে। অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তাভোগীদের বড় অংশই ভুয়া ও অস্তিত্ববিহীন।
বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যশস্য সরবরাহের ওপর উৎস কর ২ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ঘোষণার উদ্দেশ্য ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার স্থিতিশীল করা, যদিও কর ও শুল্ক ছাড়ের ঘোষণায় পণ্যের দাম কমেনি। উল্টো অর্থবছরের প্রথম মাসে প্রতিটি পণ্যের দাম আরো বেড়ে যায়।
এর প্রভাবে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে ১১.৬৬ শতাংশে ঠেকে, যা দেড় দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। জুলাইজুড়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সংঘাত-সংঘর্ষের জের ও সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে অর্থনীতিতেও ছিল নজিরবিহীন স্থবিরতা।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে দিশাহারা দেশের সাধারণ মানুষ। ডলার সংকট, রিজার্ভের বড় ক্ষয়সহ বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বিপদে ছিল দেশ। এর পরও প্রতিবারই ঘোষিত বাজেটের আকার আগেরবারের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। পতিত সরকারের ১৫ বছর সাত মাসের শাসনামলে সরকারের ঋণ বেড়েছে ১৫ লাখ কোটি টাকার বেশি। ফলে বাজেটের বড় অংশই ব্যয় হচ্ছে ঋণের দায় পরিশোধে। এভাবেই চলেছে সরকারের বড় আকারের বাজেট। বাজেটের একটি বড় অংশই চুরি ও দুর্নীতি হয়েছে। বিদেশেও পাচার হয়েছে প্রচুর অর্থ।
সে ক্ষেত্রে আমরা বলতেই পারি, চলতি অর্থবছরের বাজেটে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে। দেশের বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ বিবেচনায় রেখেই প্রণীত হয়েছে জনবিমুখ এই বাজেট। তাই অন্য অনেক সিদ্ধান্তের মতো রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে বাজেটে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পরিবর্তন এনে জনগণের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে এতত্সংক্রান্ত পদক্ষেপ নেওয়া নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য জরুরি। পৃথিবীর অনেক দেশেই নির্বাচন বা অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা বিবেচনায় সাময়িক বা পরিপূরক বাজেট করা হয়।
জণকল্যাণে নতুন যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা হলো মূল্যস্ফীতি কমানো, রাজস্ব আহরণের বাস্তবভিত্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ অর্জনযোগ্য মূল্যায়ন করা, খেলাপি ঋণ আদায় ও খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা এবং জনগণের ওপর পরোক্ষ করের বোঝা কমানো। এ ছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে। বিদ্যুৎ, পানিসহ যাতায়াতব্যবস্থা আরো সাশ্রয়ী হওয়া প্রয়োজন।
৩০ জুন চলতি অর্থবছরে সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট পাস হয় সংসদে। সেখানে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। আর দুই লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে ঘাটতি বাজেট। এই ঘাটতি মেটানোর কথা ব্যাংকসহ দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে। বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে দুই লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) হিসেবে। বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ৬.৭৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়েছিল, যদিও অর্থবছরের প্রথম মাস তথা জুলাইয়েই মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় দ্বিগুণে।
অভিজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, এডিপি কাটছাঁট করার পাশাপাশি অপব্যয় ও দুর্নীতি বন্ধ হলে সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকায় নেমে আসবে। এ অবস্থায় অগুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প বাদ দিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষার মতো খাতগুলোতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। একতরফা শাসনের ধারায় সংসদ সদস্যদের থোক বরাদ্দ বাদ দিলেও অনেক সাশ্রয় হতে পারে।
রাজস্ব আহরণ, সরকারি ব্যয় এবং বাজেট ঘাটতি ও তার অর্থায়ন—বাজেটের তিনটি অংশ। বাজেটে ব্যয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা অর্থায়ন করা সম্ভব কি না, সেটি পরীক্ষা করা দরকার। কারণ বর্তমানে দেশ আর্থিক টানাপড়েনের মধ্যে আছে। আবার রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্য দেওয়া আছে, সেটি কতটুকু অর্জনযোগ্য তার একটি বাস্তবভিত্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নও করতে হবে। কেননা সরকার অধিক মাত্রায় পরোক্ষ কর নির্ভরশীল হওয়ায় সেটি আদায় করা কঠিন হয়ে পড়বে। আবার ঘাটতি বাজেট সংস্থানে যেসব উৎসর কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে একটি দেশীয় ব্যাংক খাত। কিন্তু দেশের ব্যাংকগুলো অনেক দিন ধরেই তারল্য সংকটে ভুগছে, তার মধ্যে এ খাত থেকে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে যে ঘাটতি পূরণের কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়।
প্রতিবছরই বড় অঙ্কের ঘাটতি বাজেট ঘোষণা করা হয়। এতে সরকারের ঋণের বোঝা ক্রমেই বেড়েছে। ২০০৯ সালে পতিত সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের সময় ঋণ স্থিতি ছিল মাত্র দুই লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত জুন শেষে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের স্থিতি ছিল অন্তত ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে বিগত সরকারের দেড় দশকের শাসনামলেই সরকারের ঋণ স্থিতি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা বেড়েছে, যা সরকারের মোট ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিগত শাসকদের দেড় দশকের শাসনামলে দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি টাকা বা ১৪৯.২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী)।
উন্নয়ন প্রকল্পসহ পরিচালন খাতে সরকারের অপব্যয় ও দুর্নীতির বোঝা জনগণের ওপর পড়ছে। জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে। আবার সেসব পণ্যের ওপর শুল্কও বেশি হারে পরিশোধ করতে হচ্ছে। ধনীদের কাছ থেকে আয়কর আহরণে ব্যর্থতার কারণে মূল্য সংযোজন করের (মূসক) ওপর সরকারকে বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়ছে। অন্যদিকে কর ফাঁকি দেওয়া কালো টাকার মালিকদের প্রায় প্রতিবছরই অর্থ বৈধ করার নামে অন্যায্য সুবিধা দেওয়া হয়, যা চলতি অর্থবছরের বাজেটেও বহাল ছিল।
দেশের আর্থিক খাতের মূল চালিকা ব্যাংক খাত। সরকারের ঋণ গ্রহণ, পুনঃ তফসিল, অবলোপন ও বেনামি ঋণের কারণে ব্যাংক খাতের অবস্থা নাজুক। গত মার্চের শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। জুন শেষে তা দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে বলে খবর এসেছে। অথচ ২০০৯ সালে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। যদিও অনেকে বলছেন, বেনামি ঋণ, পুনঃ তফসিলকৃত ও অবলোপনকৃত ঋণসহ আদায় হবে না এমন ঋণের পরিমাণ অন্তত পাঁচ থেকে সাত লাখ কোটি টাকা।
সন্দেহ নেই, অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটকে পরিবর্তন ও সংস্কার করে জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে এবং খেলাপি ঋণ আদায়, উন্নয়ন প্রকল্পসহ পরিচালন খাতে সরকারের অপব্যয় ও দুর্নীতি রোধ করে প্রয়োজনীয় জোরালো পদক্ষেপের ঘোষণা আসা উচিত। জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানিসহ সব ধরনের পণ্য ও সেবা আরো সাশ্রয়ী করতে হবে। জনগণের ওপর করের বোঝা কমিয়ে, মূল্য সংযোজন করের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সরকারকে প্রত্যক্ষ করের হার বাড়ানোতে জোর দিতে হবে। মানুষ স্বস্তিতে থাকবে। আর্থিক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান—বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অর্থ বিভাগ—সেগুলোতে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার করে আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করাও জরুরি। সেই সঙ্গে আকাঙ্ক্ষিত সংস্কারের আলোকে সামগ্রিক বাজেট প্রক্রিয়ায় অভিনবত্ব আনাও সময়ের দাবি বৈকি।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক