খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি: খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালির সংঘর্ষের জের ধরে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতভর জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে সদরসহ পুরো জেলায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাতের গোলাগুলি ও বিকেলের সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন রাঙ্গামাটিতে একজনসহ পার্বত্য জেলায় চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত: শতাধিক।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন জেলা সদরে স্বর্নিভর জামতলার জুনান চাকমা(২০), ধনঞ্জয় চাকমা(৫০) ও রুবেল ত্রিপুরা(৩০)। লারমা স্কয়ার ঘটনায় ডাব(নারিকেল) বিক্রেতা দীঘিনালা কামুক্যাছড়া তুলা পাড়ায় বাসিন্দা লেনিন চাকমা(৪৫) নামে আহত অবস্থায় চমেক হাসপাতালের নেওয়া পথে নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে পুলিশ নিশ্চিত করতে পারেনি। বৃহস্পতিবার রাতে(আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টা) জেলা শহরের নারানখখাইয়া, স্বনিভর এলাকায় ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা যায়। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গভীর রাত পর্যন্ত গুলির শব্দ পাওয়া যায়।
এর মধ্যে ধনঞ্জয় চাকমা দীঘিনালায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংঘর্ষে মারা যান। অপর তিনজনকে আহত অবস্থায় রাতে খাগড়াছড়ি সদর থেকে আধুনিক হাসপাতালে আনা হয়।
খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা(আরএমও) রিপল বাপ্পি চাকমা বলেন, রাতে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ১৬জনকে আনা হয়। তাঁরা বেশির ভাগই সদর উপজেলা থেকে রাতে এসেছেন। এর মধ্যে তিনজন মারা যান। নিহত ব্যক্তিদের মৃত্যুর কারণ ময়না তদন্ত শেষে বলা যাবে।
রিপল বাপ্পি চাকমা আরএমও জানান, রাতেই চারজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ(চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে একজন বাঙালি রয়েছেন। আহত বাকি ৯পাহাড়িকে খাগড়াছড়ি জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব বলে তিনি জানান। তিনজনের মরদেহ জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন সোহেল চাকমা, মানব ত্রিপুরা, বিজয় চাকমা ও নলেজ চাকমা। ‘দীঘিনালা ও সদর উপজেলা থেকে আসা ৯জন বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর বাইরে উন্নত চিকিৎসার জন্য চারজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।’
এছাড়াও হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চারজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদের পাযে, কোমরে ও পেটে গুলি লেগেছে।
মৃত: ধনঞ্জয় চাকমার ছেলের ভাষ্যমতে(নাম প্রকাশের অনিছুক) বাবাকে সেনাবাহিনীরা তুলে নিয়ে রক্তাক্ত জক্ষম করে রাস্তায় লাশটি ফেলে যাওয়ার অভিযোগ করেছে। এছাড়াও গতকাল(বৃহস্পতিবার) রাত ১০টার দিকে সেনাবাহিনীর গুলিতে গুলিবিদ্ধ ও আহত হয়ে ৭থেকে ৮জন হাত-পা ভাংগা জক্ষম অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রশাসন সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে দীঘিনালা লারমা স্কয়ার এলাকায় পাহাড়ি-–বাঙালি সংঘর্ষ বাধে। বুধবার মো: মামুন(৩০) নামের এক ব্যক্তিকে মোটর সাইকেল চুরির অভিযোগ মারধরের ঘটনার জের ধরে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় বলে জানা গেছে। আহত মামুন বুধবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার বাসিন্দা।
এ ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকেলে দীঘিনালায় বাঙালিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এ সময় পাহাড়িরা মিছিলে বাধা দেন বলে অভিযোগ। তখন সংঘষের সূত্রপাত হয়। একপর্যায়ে পাহাড়িদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পাহাড়িরা ঘরবাড়ি ছেড়ে গহিন পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যান।
দীঘিনালা লারমা স্কয়ার বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিপন চাকমা বলেন, জেলা সদরে মোটর চোর মামুন হত্যার প্রতিবাদে দীঘিনালা কলেজে ছাত্রদলে সভাপতি নেতৃত্বে কলেজ গেইট সংলগ্ন থেকে মিছিলটি বের হয়ে থানা বাজার ঘুড়ে উপজেলা পদক্ষিন করে। পরে লারমা স্কয়ার বাজারে দিকে আসলে মিছিল ভিতর থেকে ইট নিক্ষেপ করলে আমার মাথায় আঘাত প্রাপ্ত হয়। এতে গুরুত্বও আহত অবস্থায় লুটে পড়লে পার্শবর্তী দোকানীরা এগিয়ে আসে। পরক্ষনে পাহাড়ি-বাঙালির দাওয়া-পাল্টা-দাওয়া হলে উভয়ে সংঘর্ষের রুপ নেয়। দীঘিনালা বাস টার্মিনাল মসজিদ থেকে ইমাম মাইকের ঘোষনা দিয়ে বলে বাঙালিরা সামনে এগিয়ে যাও, পিছু হটবেন না। এ ঘটনায় হতাহত যেমন হয়েছে, বাঙালি দুর্বৃত্তরা দোকানে আগুন ধরিয়ে দিলে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়।
বোয়ালখালী বাজার এলাকার বাসিন্দা মো: লোকমান হোসেন বলেন, মামুন হত্যার বিচারের দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে তাঁরা মিছিল বের করেছিলেন। পরে পাহাড়িরা এসে বাধা দিয়েছেন। এ জন্য ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছে। লোকমান বলেন, ‘এভাবে ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হবে, এটা কখনো ভাবিনি।’
লারমা স্কয়ার এলাকার বাসিন্দা রিপন চাকমা বলেন, মিছিলে পাহাড়িরা কেউ বাধা দেননি। মিছিল থেকেই অতর্কিতভাবে হামলা চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে।
এ ঘটনার পর গতকাল খাগড়াছড়ি শহরে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। এর জের ধরে বৃহস্পতিবার রাতে শহরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। রাতভর সেখানে আতঙ্ক বিরাজ করে। সীমিত করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট সেবা। সদরের বাসিন্দারা অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান।
দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ বলেন, আগুনে দীঘিনালা বাসস্টেশন ও লারমা স্কয়ার এলাকায় ১০২টি দোকান আগুনে পুড়ে গেছে। এর মধ্যে চাকমা সম্প্রদায়ের ৭৮টি ও বাঙালির সম্প্রদায়ের ২৪টি দোকান রয়েছে। ভাঙচুর হয় চারটি দোকান। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মিলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে কাজ করছেন। প্রশাসন নিরাপত্তা জোরদার করেছে।
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো: সহিদুজ্জামান শুক্রবার সকালে বলেন, ‘রাতে গোলাগুলি হয়েছে। এ পর্যন্ত তিনজনের লাশ পাওয়া গেছে। মরদেহ জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালে রয়েছে। আহত হয়েছেন ১০ থেকে ১২জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা পুলিশ সুপারসহ ঘটনাস্থল দীঘিনালায় উভয়ে শান্তি সমাবেশ করতে যাচ্ছি। সেখানে গিয়ে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করব। একটা থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।’
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক(ডিসি) মো: সহিদুজ্জামান জানান, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আমাদের টিম কাজ করে যাচ্ছে। আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের সঙ্গে কথা বলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছি।
মো: সহিদুজ্জামান আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’ শুক্রবার(২০শে সেপ্টেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের উপমহাপরিদর্শক(ডিআইজি) আহসান হাবিব পলাশ গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
চট্টগ্রাম ডিআইজি পলাশ জানান, ধনঞ্জয় গত রাত সাড়ে ১০টায় এবং রুবেল ও জুনান রাত দেড় টায় মারা গেছেন। এদের মধ্যে ধনঞ্জয দীঘিনালায় এবং রুবেল ও জুনান সদরে আহত হয়েছিলেন। খাগড়াছড়ি আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়। এদিকে হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, রুবেল ও জুনান গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
উপ-মহাপরিদর্শক পলাশ আরো বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়া শেষে মরদেহ স্ব-স্ব পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথভাবে টহল দিচ্ছে।’
স্থানীয় সূত্র অনুসারে, গত রাতেও খাগড়াছড়ি সদর এলাকায় গুলির শব্দ শোনা গেছে। থমথমে পরিস্থিতিতে দীঘিনালায় অনেকে গত রাতেই নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিয়েছেন। আবার অনেকে ভারত সীমান্তবর্তী পাড়ি জমিয়েছেন।
পুলিশের এ কর্মকর্তা যোগ করেন, ‘খাগড়াছড়ি শহরে রাতে গুলির শব্দ শোনা গেছে। সেখানে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টহল দিচ্ছে। পরিস্থিতি নিযন্ত্রণে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’
এদিকে গত বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় পাহাড়িদের অন্তত: ৩০টি বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেওযা হয়। মোটর সাইকেল চুরির অভিযোগে মামুন নামে একজনকে পিটিয়ে হত্যার জেরে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৩জনের লাশ এসেছে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে। তার মধ্যে একটি লাশ এসেছে দীঘিনালা থেকে। এছাড়া আহত হয়ে আরো ১৭জন খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে আরএমও ডাক্তার রিপল বাপ্পি।
সেনাবাহিনীর দীঘিনালা জোন অধিনায়ক লে. কর্নেল ওমল ফারুক, জেলা প্রশাসক মো: সজিদুজ্জামান ও পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল শুক্রবার দুপুরে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত দীঘিনালা বাজার হতাহতদের দেখতে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতলে যান। এ সময় তারা গুজবে কান না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, শৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের সাথে নিয়ে সমন্বিত কাজ চলছে।
উল্লেখ্য, বুধবার সকালে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে এক বাঙালি যুবককে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এর প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকালে দীঘিনালা সরকারি কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল হামলা চালানো হয়। হামলার ঘটনার জেরে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ফাঁকাগুলি ও অর্ধ শতাধিক দোকানপাটে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
উল্লেখ্য খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা শহরের পানখাইয়া পাড়া নিউজিল্যান্ডের নোয়াপাড়া এলাকা থেকে মো: মামুন(৩০) নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। বুধবার(১৮ই সেপ্টেম্বর) ভোর সাড়ে ৪টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। চুরির দায়ের অপরাধে গণপিটুনিতে তার মৃত্যু হয়েছে এমনটাই ধারণা করছেন এলকাবাসী। বুধবার ভোরে পানখাইয়া পাড়া এলাকা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃত মামুন জেলা শহরের মধ্যশালবাগান এলাকার মৃত নূর নবীর ছেলে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, মামুন শালবাগান নিজ এলাকায় কাঠের ফার্নিচারের ব্যবসা করেন। মামুন চুরির অপরাধে এর আগেও বেশ কয়েকবার জেল খেটেছেন। তার মরদেহের পাশে একটি মোটর সাইকেল পড়েছিলো।
আরো উল্লেখ্য, বাঙ্গালী সংগঠনগুলোর দাবী, একটি আঞ্চলিক দলের সদস্যরা তাকে হত্যা করে। সেনাবাহিনী সৃষ্ট ইউপিডিএফ গনতান্তিক(সংস্কার) সংগঠনকে দায়ী করেছে। এ ঘটনার ভিডিও স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলে বাঙালিদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়।
পিপি/ আরটি