কুমিল্লা প্রতিনিধি: জগন্নাথ দিঘি। আয়তনে বিশাল এ দিঘিটি ‘পরীর দিঘি’ নামেও ব্যাপক পরিচিত। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলা সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে অবস্থিত এই দিঘি প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন এক ভিন্ন ধাঁচের হেরিটেজ। দিঘিটি ১২২ দশমিক ৫ বিঘা জমি নিয়ে খনন করা হয়েছে। দেশের ঐতিহাসিক দিঘিগুলোর মধ্যে চৌদ্দগ্রাম উপজেলার এই জগন্নাথ দিঘি সবচেয়ে বড় বলে দাবি করা হয়। এই দিঘির নামানুসারে স্থানীয় ইউনিয়নের নামকরণও করা হয়েছে জগন্নাথ দিঘি। প্রতিদিনই পরীর দিঘির পাড়ে ভিড় করেন দূর-দূরান্তের দর্শনার্থীরা।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেছে, ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুরের জমিদার, পরবর্তীতে একই রাজ্যের এক যুগেরও বেশি সময়ের মহারাজা বাঙলার বাঘ বা ভাটির বাঘখ্যাত সমশের গাজী এই দিঘিটি খনন করেন। ত্রিপুরা রাজ্য শাসনের সময় মহারাজা সমশের গাজীর বহু জনহৈতিষী কাজের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই দিঘি খনন। আজ থেকে ২৮৬ বছর আগে ১৭৩৯ সালের দিকে এ অঞ্চলের তৎকালীন হিন্দু জমিদার জগন্নাথ সেনের নামানুসারে এই দিঘিটির নামকরণ করা হয় জগন্নাথ দিঘি।
কথা সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট লেখক জহির রায়হান তার ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে জগন্নাথ দিঘির কথা বর্ণনা করেছেন এবং এ দিঘিটিকে এক বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে পরীরা খনন করেছে উল্লেখ করে এর নাম ‘পরীর দিঘি’ বলে বর্ণনা করেন। সেই থেকে বিশালত্বের জন্য জগন্নাথ দিঘিটি পরীর দিঘি নামেও বেশ পরিচিত। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কালের পরিক্রমায় যাতায়াত সুবিধা হওয়ায় এ দিঘির পাড়ে গড়ে উঠেছে জনবসতি।
আশির দশকে দিঘিটির পূর্ব ও দক্ষিণ পাড়ে সরকারিভাবে গড়ে তোলা হয় ১০০ পরিবারের একটি আদর্শগ্রাম (গুচ্ছগ্রাম)। বর্তমানে এই গুচ্ছগ্রাম ও আশপাশের বসতিকে কেন্দ্র করে দিঘি এলাকায় হোটেল-রেস্তোরাঁসহ নানারকম ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ দিঘির পশ্চিম পাড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোর লেন মহাসড়ক, এর পাশে রয়েছে নামকরা দিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নারাণকরা জামেয়া মাদরাসা, পাশেই রয়েছে একটি স্কুল ও কলেজ। এছাড়া দিঘির উত্তর পাড়ে রয়েছে গণকবর এবং দক্ষিণ পাড়ের পশ্চিম কোণে রয়েছে সরকারি ডাক বাংলো। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধকালে জগন্নাথ দিঘিকেন্দ্রিক অনেক স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। এ দিঘির চারপাশে ছায়াঘেরা শান্ত মনোরম পরিবেশ। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-গাছালি আর পাখির কল-কাকলী যে কাউকে মুগ্ধ করে।
জ্যেষ্ঠ নাগরিক আলী আকবর (৮৫), নারায়ণ চন্দ্র ভৌমিক (৮২) ও অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক মীর শাহ আলম (৬৫) ও বেশ কয়েক জন বাসিন্দা বলেন, প্রায় ৩০০ বছর আগে অত্র এলাকার প্রজাদের পানীয় জলের সংকট নিবারণে তৎকালীন মহারাজা বিশালাকার এই দিঘিটি খনন করেছিলেন। এটি একটি রহস্যময় দিঘি, এর পানি শুকাতে কেউ দেখেনি। স্বচ্ছ পানির দিঘিটি জেলার অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান। সচক্ষে না দেখলে এর সৌন্দর্যের বিষয়টি বলে বুঝানো যাবে না।
প্রতিদিনই ঢাকা ও চট্টগ্রাম পথে প্রাইভেট কার, জিপ, মাইক্রোবাসসহ নিজস্ব বাহনে যাতায়াতকারী ছাড়াও দূর-দূরান্তের অসংখ্য মানুষ পরীর দিঘি দেখার জন্য ভিড় করেন। দিঘির পাড়ে ঘুরে তারা প্রকৃতির অসামান্য সৌন্দর্য উপভোগ করেন। কথা হয় চাঁদপুর থেকে আসা দর্শনার্থী প্রবাসী আবদুল খালেকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পনেরো দিন আগে সৌদি আরব থেকে বাড়ি এসেছি। স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ চট্টগ্রামে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার পথে পরীর দিঘিটি ঘুরে দেখছি। পূর্ব পুরুষদের মুখে এ দিঘির অনেক কল্পকথা শুনেছি। এর অপরূপ সৌন্দর্য যতো দেখছি ততোই ভালো লাগছে।’
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. জামাল হোসেন বলেন, জগন্নাথ দিঘি এতদাঞ্চলের প্রাচীনতম এক ভিন্ন ধাঁচের হেরিটেজ। বিশালায়তনের জন্য উপন্যাসে এটিকে পরীর দিঘি আখ্যায়িত করা হয়েছে। এটি শুধু কুমিল্লা নয়, দেশের একটি বড় ও ঐতিহাসিক জলাধার। দিঘির নান্দনিক সৌন্দর্য রক্ষায় ও দর্শনার্থীদের নিরাপত্তায় উপজেলা-পুলিশ প্রশাসনের নজরদারি রয়েছে।
পার্লামেন্ট প্রতিদিন/ এমআর