মাহবুবুর রহমান: সালাত হলো মুসলিমের মূল বা প্রধান ইবাদত। ছোট কাল থেকেই এই সালাতের গুরুত্ব কথা শুনে আসছি আমরা। এই সালাতকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর সকল খানকা ও মসজিদ প্রতিষ্ঠিত। আমরা যারা বাংলাদেশী সালাতকে আমরা নামাজ বলেই বেশী জানি।
বিভিন্ন প্রকার সালাত বা নামাজ আছে। এই নামাজের প্রকার ভেদ হলো- ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, নফল নামাজ। বিভিন্ন ধরণের নামাজ হলো- ফজর, জোহর, আসর, মাগরিব, এশা, জুমা, জানাজা, সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সময় নামাজ, বৃষ্টির নামাজ, তারাবিহ, মাসবুক, মুসাফির, বিতর, সালাতুল ঈদাইন, ইশরাক, তাহাজ্জুদ, জাওয়াল,আউওয়াবিন, দুখুলিল মাসজিদ, খুরুজুল মানজিল, সালাতুল হাজাত, সালাতুল কাজায়িদ দাঈন বা ঋণ পরিশোধ, সালাতুল ফাকা, সালাতুস শোকর, সালাতুত তাওবা, সালাতুল মাতার, সালাতুল নাউম, সালাতুল সাকরাতুল মউত ইত্যাদি। আরো সালাত বা নামাজ থাকতে পারে, তবে আমার জানা নেই।
এই সালাত শব্দের বাংলা অর্থটি কি আমরা বেশীর ভাগ সাধারণ মুসলিমেরা জানি না। বেশীর ভাগ সাধারণ মুসলিম শুধু মাত্র বেহেস্তে যাওয়ার জন্য সালাত বা নামাজ পড়ি। আল্লাহতো সালাত বা নামাজ পড়তে বলে নাই। সালাত বা নামাজ কায়েম করতে বলেছে। পড়তে বলে নাই। পড়া এবং কায়েমের অর্থ বেশীর ভাগ মুসলিম জানে না।
আমি যতটুকু জানি সালাত শব্দের বাংলা অর্থ সংযোগ স্থাপন করা। কার সাথে সংযোগ স্থাপন করবো? আল্লাহর সাথে সংযোগ স্থাপন করা। আল্লাহর সাথে কিভাবে সংযোগ বা যোগাযোগ স্থাপন করবো? এখানেই হলো আসল কথা। আল্লাহ’র আসমানি কিতাব বা ঐশিবাণী মানুষের কাছে প্রেরণের জন্য একটা মাধ্যম ব্যবহার করেছেন। সেই মাধ্যমটা হলো জিবরাইল নামক ফেরেস্তা হয়ে সকল নবী রাসুল এর মাধ্যম হয়ে সাধারণ মানুষ। আল্লাহ সর্বশক্তিমান তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাহলে এই সর্বশক্তিমান আল্লাহ সরাসরি আসমানি কিতাব না দিয়ে কেন মাধ্যম ব্যবহার করলেন?
আল্লাহ জিবরাইল আমিন হযরত আদম (আ.) তারপর আল্লাহর বান্দা আসমানি কিতাব পেলেন। কোরআনে বর্ণিত পঁচিশ জন নবী বা রাসুল এইভাবে আসমানি কিতাব পেয়ে মানুষকে হেদায়াত করেছিলেন। না সরাসরি আল্লাহর সাথে যোগাযোগ বা সংযোগ হয়েছে? না সাধারণ মানুষ জিবরাইল (আ.) কে দেখেছেন? তাহলে না দেখো কোন কিছুর সাথে বা না দেখো কোন মানুষের সাথে কিভাবে সংযোগ বা যোগাযোগ করবো? এখানেই সালাত বা সংযোগ বা যোগাযোগের প্রশ্ন।
রাসুল(স.) বলেছেন এটা আল কোরআন বা আল্লাহর বাণী, এই কথাই আমরা বিশ্বাস করেছি। এইটা হাদিস বা আমার বাণী, এই কথাই আমরা বিশ্বাস করেছি। আল কোরআন বা হাদিস এই দুই ধরণের ভাগ করা কথা দুইটাই রাসুল(স.) মুখ থেকে শুনেছি। সে জন্যই কোরআন শরীফের সুরা আল ইমরানে আল্লাহ বলেছেন ‘‘কে আমাকে ভালোবাসতে চাও? সে যেন আমার রাসুল(স.) কে ভালোবাসে। এখানে আল্লাহ কে ভালোবাসতে বলেননি, বলেছেন রাসুল(স.) কে ভালোবাসতে। রাসুল(স.) কে ভালোবাসার নামই হলো আল্লাহকে ভালোবাসা। অন্য এক হাদিসে আছে ‘‘যারা রাসুল(স.) কে দেখেছেন, তারাই আল্লাহ দেখেছেন।’’ এখানে প্রশ্ন আসতে পারে আবু জাহেল ও আবু লাহাবও রাসুল(স.) দেখেছেন। ‘‘সেই জন্যই কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, তারা আল্লাহ রাসুল(স.)কে দেখিতেছে অথচ দেখিতেছে না।”
তাহলে রাসুল(স.) এর সাথে সংযোগ রাখা বা যোগাযোগ রাখার নামই সালাত নয় কি?? আল্লাহর কথা রাসুল(স.) এর মুখ থেকে শুনলাম আবার হাদিস নামক রাসুল(স.) এর কথা উনার কাছ থেকে শুনলাম। এই দুই শুনার বিষয়ে জ্ঞানীদের জন্য সুসংবাদ।
নামাজ বা সালাত বেহেস্তের চাবি আর নামাজের চাবি হলো ‘‘তাহরাত”। তাহরাত শব্দের অর্থ হলো ‘পবিত্রতা।’ আমি যদি হাত মুখ ধৌত করি তাহলে আমরা নিজেকে পবিত্র মনেকরি। দেহের পবিত্রতা যদি অজু হয় তাহলে মনের পবিত্রতা কি দিয়ে হবে?
আমরা যে নামাজ বা সালাত পড়ছি সেই নামাজ বা সালাত দিয়ে কি কখনো পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র পরিবর্তন হচ্ছে? সাধারণত এই ধরণের নামাজ বা সালাত দিয়ে কোথাও কোন পরিবর্তন হতে দেখছি না। যদি পরিবারে সমাজে রাষ্ট্রে নামাজ বা সালাতের প্রচলন থাকে তাহলে এত অনিয়ম কি করে হয়? পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে অনিয়ম, মিথ্যাচার, ঘোষ, দুর্নীতি, সম্পত্তির হের-ফের, নির্যাতন, বৈষম্য, দেন মোহর না দিয়ে বিয়ে, জুলুম, অত্যচার, রাহাজানি, ভিক্ষাবৃত্তি, চাঁদাবাজি, এতিমের নামে টাকা তুলে আত্মসাৎ, মসজিদের ইমাম, মতোয়াল্লি ও মোয়াজ্জিম হয়ে মসজিদের সম্পদ নিজের নামে করে নেওয়া, ধর্মের নামে মব জাস্টিস ইত্যাদি নানা ধরণের অনিয়ম সর্বত্রে লেগেই আছে। তাহলে প্রশ্ন এসেই যায় আমরা কি নামাজ বা সালাত পড়ছি না কায়েম করছি?
সুরা মাউনে আল্লাহ পাক বলেছেন লোক দেখানো নামাজি বা সালাতিদের জন্য ওয়াইল নামক দোযখ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। নানা ধরণের অপকর্ম করে নামাজ বা সালাত পড়ে আমরা কিভাবে বেহেস্ত আশা করতে পারি?
সুরা মাউনের ভাষায় আমি যদি নামাজ বা সালাত কায়েম করি তাহলে আমি কখনো এতিম, মিসকিন, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনের জন্য খারাপ আচরণ করতে পারি না। আমরা নামাজ পড়ি কিন্তু আত্মীয়দের সাথে সর্ম্পক নেই। আমরা নামাজ পড়ি এতিমকে তাড়িয়ে দিই, আমরা নামাজ পড়ি মিসকিন অসহায়ের পাশে থাকি না, আমরা নামাজ পড়ি পাড়া প্রতিবেশীর সাথে খারাপ আচরণ করি। আমরা নামাজ পড়ি মাউন দিই না। মাউন কি? মাউন হলো সংসারের টুকিটাকি জিনিস পত্র পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত-অপরিচিতদের সাথে ধার-দেনা। যেমন একটু লবন, তেল, দা-বটকি, কোড়াল বা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের আদান প্রদান। এই সকল জিনিস থাকার পরও না দেওয়া এবং অস্বীকার করাকে কোরআনের ভাষায় তাকে নামাজি নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
যারা এতিম, মিসকিন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে সুসর্ম্পক নেই। মাউন দেয়না, তারা কখনো মুসল্লি নয় এবং তারা নামাজ বা সালাত কায়েম করে নাই। যারা সালাত কায়েম করে নাই তারা কখনো আল্লাহর সাথে সংযোগ বা যোগাযোগ করে নাই। তাদের জন্য বেহেস্ত হারাম নয় কি?
সস্তা বেহেস্তের দোহায় দিয়ে যারা সাধারণ সহজ সরল মুসলিমদের নিয়ে ব্যবসা করে নিচ্ছে তাদের কি হবে? পবিত্র কোরআনের সুরা আল মারিজের ২৩নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘‘আল লাযীনা হুম আলা-সালা-তিহিম দা-ইমুন’’ অর্থাৎ তোমরা সব সময় দায়েমী সালাতে রত থাকো। আর হাদিস শরীফে বলা হয়েছে, ‘‘আস সালাতুদ দায়েমী আফজালুম মিনাল সালাতিল ওয়াকতি’’ অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের চেয়ে দায়েমী সালাত অনেক বেশী দামী বা গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে প্রশ্ন এসে যায় দায়েমী সালাত যদি গুরুত্বপূর্ণ হয় সেই সালাত মসজিদের ইমাম সাহেবেরা পড়েনা কেন? বা পড়ায় না কেন? বা সাধারণ মুসল্লি জানে না কেন? যে দায়েমী সালাতের কথা বলা হয়েছে সেই দায়েমী সালাত সাধারণ মানুষতো দূরে থাক আরবী শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক মোল্লা-মুন্সিরাই জানে না।
সালাত কায়েম করতে হলে কোরআনের ৮২ স্থানে বর্ণিত অন্তত পক্ষে ৮২ ধরণের শর্ত আপনাকে মানতে হবে। শুধু মাত্র দিনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের কথা বলে মাটিতে সিজদা দিলে সালাত হয় না হবেও না। সালাত পড়ার বিষয় নয়। সালাত কায়েম করার বিষয়। সালাত হলো বৃক্ষের শিকড়। যেভাবে গাছকে দাঁড় করিয়ে রাখে। তেমন এই সালাতই পুরো মুসলিম জাতিকে উন্নত করে রাখবে।
মুসলিম জাহান শুধু মাত্র নামাজ বা সালাত পড়ছে বিধায় মিথ্যা ছাড়তে পারেনাই। ঘুষ নেওয়া থেকে বিরত হতে পারে নাই। রাসুল (স.) এর শিক্ষিত হতে পারে নাই। নারী নির্যাতন বন্ধ করতে পারে নাই। বোনদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে পারে নাই। একে অপরের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে নাই। অন্যের ধর্মকে সম্মান দিতে পারে নাই। মানুষের মানবিক যে মূল্যবোধ সেটা শিখে নাই। অহংকার, হিংসা, লোভ, লালসা, ক্ষোভ, মোহ, সম্পদের মায়া ছাড়তে পারে নাই। নিজের বিবেককে জাগ্রত করতে পারে নাই। আর পৃথিবীর অন্য কোন মতের মানুষকে সম্মান দেখাতে পারে নাই। বেহেস্তের আশা ছেড়ে আল্লাহ বিশাল রহমত ও অনুগ্রহের সন্ধান পাই নাই। নামাজ বা সালাত না পড়ে ‘‘এসো সালাত কায়েম করি।’’ দায়েমী সালাতের সন্ধান করি। ফুঁটে উঠবে পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করার আসল উদ্দেশ্য। পৃথিবীর জন্য মুসলিমের যে অনেক দায়িত্ব আছে। সেই দায়িত্ব, মুসলিম এবং তার আসল চরিত্র প্রকাশ করার জন্য সালাত কায়েমের বিকল্প নেই। যদি সর্বত্রে সালাত কায়েম না করেন তাহলে এই নামাজ বা সালাত পড়ার নামে ভ-ামী চলতে থাকবে আজীবন। পিছিয়ে পড়ছে, পিছিয়ে পড়বে মুসলিম জাতি।
লেখক: সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।
ই-মেইল: lvlchkm885@gmail.com
তারিখ: বুধবার : ২০.১১.২০২৪ইং