আকতার কামাল চৌধুরী
প্রিয় আচিয়া,তোমার কচি শরীর নিংড়ে দিয়ে যে তোমার প্রাণ সংহারের কারণ হয়েছে তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়েছে। তিনি আর কেউ নন, তোমারই তালই হিটু শেখ। প্রিয় আচিয়া,এই বয়সে তোমার মৃত্যু সবাইকে যত না কাঁদিয়েছে, তারচেয়ে বেশী ভাবিয়েছে। তোমার উপর যে পাশবিকতার ধকল গিয়েছে তা ভাবলে শিউরে ওঠতে হয়।
পুরো দেশ তোমার আর তোমার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে। তোমার জন্য সবাই রাস্তায় নেমেছে, বজ্রকণ্ঠে মিছিল করেছে,সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তোলেছে,অশ্রু ঝরিয়েছে। জনতার এমন দেশ কাঁপানো প্রতিবাদের মুখে সরকার আইন সংশোধন করে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা দূর করে ২১ দিনের মধ্যে তোমার হত্যার বিচারের পথ সুগম করেছে। এমনকি সরকার তোমার জীবন বাঁচানোর জন্য সর্বোচ্চ চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেছে।
মাটির নিচ থেকে তোমার আত্মাও আজ শান্তি পাচ্ছে এই রায়ে। তবে এ রায়-ই কি শেষ কথা? না,রায়-ই শেষ কথা নয়। এ সমাজকে তুমি হাড়েহাড়ে চিনতে,যদি বেঁচে ফিরতে। দেখতে, তোমার বিচারের জন্য সবাই আছে, তোমার জন্য কেউ নেই। জনতা তোমার তালই বাড়ির ঘর ভেঙে দিলেও তোমার ঘর তৈরি করে দেয়ার কেউ নেই।
জীবনের আরও কঠিন বাস্তবতা টের পেতে- যখন তোমার নিজেরও শশুর বাড়ির প্রয়োজন দেখা দিত। দেখতে, তোমার জন্য বর পাওয়া কত কঠিন-ই না হতো। বুঝতে, তুমি যতই সতীসাধ্বী হও, নির্যাতিতা-নিষ্পেষিতা হও,ধর্ষিতাকে বউ করে নিতে চাইবে না এই সমাজ। তোমার দুর্দশায় রাজপথে গলা ফাটানো কেউ-ই তোমার পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া অন্ত:পুরের খোঁজ নেয়ার সময়ই পাবেনা, এমনকি প্রয়োজনও মনে করবে না। সবাই হন হন করে ছুটে চলবে কর্মব্যস্ত জীবনের দিকে।
তোমার জন্য ভালোবাসা ওই রাজপথ পর্যন্তই। রাজপথের আন্দোলন পাবলিকের কাছে একটা উৎসব বৈ অন্য কিছুই নয়। তুমি সেই আন্দোলনের উপলক্ষ ছিলে মাত্র।
শুনতে খুব কঠিন বাজছে তোমার কানে ? বিশ্বাস করো আচিয়া, কঠিন সমাজে এটাই কঠিন বাস্তবতা। এটি তুমি তিলে তিলে আঁচ করতে পারতে,যদি বেঁচে ফিরতে।
তুমি বেঁচে ফিরলে দেখতে -তোমার যৌবন মানে নিজের সাথে নিজেরই এক অন্তহীন কদর্য লড়াই। এ লড়াই তোমার একার, এ লড়াই তোমার দুঃখী মা-বাবার। এক সময় কন্যাকে পাত্রস্থ না করতে পারার দুঃখে বিনীদ্র রাত কাটতো তাঁদের।
দেখতে, কখন যে তুমি তোমার মা-বাবারও বোঝা হয়ে ওঠেছো। শুরু হতো এক গ্লানিময় দূর্বীসহ জীবনের পথচলা। নির্মম দুনিয়ায় নিজেকে নিজের বোঝা মনে হতো। দেখতে, চোখের সামনে লোকজনে ভরপুর, অথচ একটাও মানুষ নাই।
প্রিয় আচিয়া, বেঁচে থাকলে দেখতে,পৃথিবীতে তোমার দেখা আগেকার সব রঙ হারিয়ে চারদিক কেমন যেন ধুসর-ফ্যাকাসে হয়ে ওঠেছে। দেখতে, দুনিয়াটা সীমাহীন ওজন নিয়ে তোমার মাথার উপর এসে বসে আছে, যে ভার বহন করা তুমি বালিকার পক্ষে অসম্ভবই। এই চেপে ধরা পৃথিবীর ভারে তোমার ঘাড় বাঁকা হয়ে যেতা,মাথা নিচু হয়ে যেতো। কিন্তু, নিষ্ঠুর দুনিয়ায় তোমার মাথার ভার নামিয়ে দেওয়ার জন্য কেউ-ই থাকতো না।
প্রিয় আচিয়া, ধর্মের আচ্ছাদনে গড়ে ওঠা আমাদের বাঙ্গালী সমাজ তোমার দুঃখে চোখের জল ফেলবে, তোমাকে তাদের সাথী করে রাখবে না। কেউ তোমার কাঁধে হাত রেখে বলবে না,’তুমি লাঞ্চিতা-নিষ্পেষিতা,তুমি অসহায়, তুমি বীরঙ্গণা,তুমি একা নও,আমি তোমার পাশে আছি,তুমিই আমার বধু,পুত্রবধূ’। না, এটা কেউ বলবেনা। সমাজ এভাবেই চল্ছে।
শুরু হতো তপ্ত বালির উপর তোমার দুর্গম যাত্রা।সেখানে তুমি একা,একদম একা। বাঙ্গালির ধাঁচে গড়া এ সমাজের বাঁকা চক্ষু আর গ্লানি থেকে বাঁচতে এ মৃত্যুর বিকল্প ছিলো না তোমার।
আচ্ছা আচিয়া,আমরা কি একবারও ভেবেছি তোমার বড় বোনের কথা? না, ভাবিনি। তোমার মৃত্যুশোকে ঢাকা পড়েছে তাঁর বুক ফাটা কষ্ট। তুমি তো মরে বেঁচে গেলে,কিন্তু তোমার বড়ো বোনের এখন কী হবে ভেবেছ? তার কি আর ফেরা হবে শাশুড়বাড়িতে? এটা অসম্ভব। স্বামী-সংসার দুই-ই গেল তাঁর। তোমার বড়ো বোনের এখন অকূলপাথার। এ অবস্থায় সমাজে তার অবস্থান কোথায়? কী-বা ভবিষ্যৎ তাঁর?
স্বামীর জেল- ফাঁসি-খালাস যা-ই হোক, সে তো আর শাশুড় বাড়ি ফিরতে পারবে না। ওখানে কে আছে, কী আছে তার? না, কেউ-ই নেই,কিছুই নেই। যারা আছে তারা পারলে তোমার বড়ো বোনকে পিষে ফেলতে পারলে বাঁচে। এই শাশুড় বাড়ি আর সেই শাশুড় বাড়ি নয়।
হয়তো আবার বিয়ের জোগাড়। কিন্তু এতো ধকল মাথায় নিয়ে তারও কি সহজে এটা মাথায় নেওয়া সম্ভব? সে তো সবেমাত্র এক নির্মম অতীত ফেলে এসেছে, যা শাশুড় বাড়ি নামের এক জলন্ত আগ্নেয়গিরির তাপের আগুনে ঝলসানো!
প্রিয় আচিয়া, তুমি হয়তো জানো না,তোমার শাশুড় বাড়ির লোকেজন এক মানসিক রোগে আক্রান্ত। এটি বিকারগস্ত মানুষের মনোরোগ। এই রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সমাজে অগুণতি। কারওটা প্রকাশ পায় নির্বুদ্ধিতা আর অতি-আত্মবিশ্বাসের কারণে, আবার কারওটা চাপা থাকে চৌকস বুদ্ধিমত্তার জোরে। নির্বোধেরা যখন ফেঁসে যায়-একই রোগে আক্রান্ত বুদ্ধিমানেরা তখন একদম সাফসুতরো। তারা ‘গেল’ ‘গেল’ বলে সমাজে হুল্লোড় তোলে।
আইন-আদালতের রায় ভিক্টিমকে প্রশান্তি দেবে,সমাজ থেকে মোটাদাগে এই রোগের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে পারবে না। এদের ভালো করতে সমাজ বিজ্ঞান লাগবে,সমাজ বিজ্ঞানী লাগবে। কারণ, আমরা এর মূলোৎপাটন চাই।
তোমার বিচারের জন্য যারা আন্দোলন করেছে তারা সবাই যে ‘সাধু-বাবা’ এমন নয়। সুযোগ পেয়ে সাধুর মিছিলে নাম লিখিয়েছে তারা। এই মিছিলগুলো পাবলিকের কাছে এক বড়ো উৎসব। অনেকের কাছে আবার বিনোদনও। ন্যায়-অন্যায়ের চেয়ে এখানে অংশগ্রহণই আসল।
প্রিয় আচিয়া, বেঁচে ফিরলে তোমার মনে হতো,’এই নরক-যন্ত্রণা দিতেই কি সমাজ তোমাকে বাঁচিয়ে এনেছিল? এই দুর্বিষহ জীবনের নাম-ই কি বেঁচে থাকা? এরচেয়ে মৃত্যু ই তো ঢের ভালো ছিল’। লেখক: প্রাবন্ধিক।
পার্লামেন্ট প্রতিদিন/এমআর