হাসান মনসুর: সকুল জীবন থেকে শুরু করে দীর্ঘ ৩৫ বছর টানা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছি – বঙ্গবন্ধু কন্যার সাথে অনেক সাদাকালো দিনের স্মৃতি – তথাপি ২০০৮ সালের পর তার ত্রিসীমানায় যেতে পারি নাই। তারপরেও এক অদৃশ্য নেশায় আওয়ামী লীগ করে গেছি। ( ১৬ বছর ৭ মাস বয়সে আমি চট্টগ্রাম মহানগরীর ৪১ টি ওয়ার্ডের ছাত্রলীগের সভাপতি সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ – সম্মেলনে সরাসরি ভোটে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত)।
আগে না বুঝে বৈঠকে আলাপে আড্ডায় বলতাম – দলের জন্য ১৯৯১-৯৬ সালে চার বার জেল খেটেছি, বঙ্গবন্ধু কন্যা ১৯৯১-৯২ সালে ঢাকায় থাকাকালে আমাকে নামে চিনতেন — পরে দেখি এসব কথা বললে অনেকে মুখ টিপে হাসে, বুঝতাম এসব কথা এখন আর মার্কেটে খায় না, নব্য হাইব্রিড সময়ে হয়তো চাপাবাজী ভাববে তাই ইদানিংকালে এসব গালগল্প করিনা।
মতবিরোধের কারনে দল থেকে ২০১৬ সালের নভেম্বরে পদ থেকে অব্যাহতি নিই – দল আমাদের মতো কর্মীদের ছেড়ে দিলেও, আমরা এই দল ত্যাগ করি নাই। শুধু আমি না- আমার চেয়ে হাজারো গুন ত্যাগী গুনী নেতাকর্মীরা মনের দুঃখ পেলেও আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে নাই – সবসময় বঞ্চিত হতো হালে পদ পাওয়া নব্য হাইব্রিড নেতাদের অবহেলা,অপমানে তারপরও দলের সাথেই আত্মিক ভাবে সম্পৃক্ত ছিলো । অর্থ, পরিবারতন্ত্র আর চাটুকারিতার কারনে ভালো মেরুদণ্ড সম্পন্ন লোকরা বিগত সময়ে দলে ঘেঁষতেই পারেনি।
এই মুহূর্তে অপারেশন পরবর্তী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তবে ফেসবুকে মেসেনজারে দুঃসংবাদ শুনি – দেশে থাকা গরীব নিরীহ অসহায় নেতাকর্মীদের বার্তায়। দিনে এনে দিনে খাওয়া সাবেক আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের নেতাদের মামলা দেওয়া হচ্ছে – বড় বড় পলাতক জাদরেল নেতাদের সাথে, মন মানেনা পরিচিত শতভাগ নিরীহ নিরপরাধী এসব নেতাকর্মীদের মামলার আসামী হওয়ার দুঃখজনক সংবাদে।
আওয়ামী রাজনীতি ও ক্ষমতার দম্ভে যারা অপকর্ম, লুটপাট, জুলুম করেছে রাষ্ট্র ও অপরের সম্পদ দখল করেছে তাদের ক্ষমা করার সুযোগ নাই। এরা আওয়ামী লীগের সুনাম সম্মান ঐতিহ্য ধ্বংস করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সাথে মোনাফেকি করেছেন। তারা হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে পবিত্র মাতৃভূমির সাথে অন্যায় করেছেন।
একদিকে আওয়ামী লীগের নামধারী কতিপয় দুর্বৃত্তদের হাজার কোটি টাকার বিলাসীতা লাফালাফি, আরেকদিকে দলের নিবেদিত প্রাণ পোড়খাওয়া অভাবী নেতাকর্মী হাজারো দুঃখে খেয়ে না খেয়ে তারপরেও আওয়ামী লীগ সংগঠন করেছে। আজ এই ত্যাগী নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীদের বিপদে ফেলে পালিয়েছে লুটেরা চক্র ।
এরা এমপি মন্ত্রী বা যতো বড় কিছুই হউক এরা অবশ্যই অপরাধী – তাদের অবশ্যই চিরতরে বর্জন ও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের ১৬ টি আসনে গত কয়েকবার থেকেই যারা দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছিলেন তাদের অনেকে জীবনে ছাত্র যুব বয়সে একদিনও যুবলীগ ছাত্রলীগ বা কোনোদিন রাস্তায় জয়বাংলা শ্লোগান দেয় নাই। একজন তো চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সজ্জন মানুষ খ্যাত মরহুম জননেতা এম, এ মান্নান ও ইন্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের পায়ের গোস্ত কিরিচ দিয়ে কেটে দিয়েছিলেন নিউমার্কেট মোড়ে। সেই ইন্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন পরবর্তীতে মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য হয়ে – সে লোককেই ৩ বার এমপি মনোনয়ন দেন- কি নির্লজ্জতা।।
১৯৯৪ সালে জামাতে ইসলামির হয়ে ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচন করে পরাজিত লোক চট্টগ্রাম শহরে ৪ বার এমপি হয়েছেন। যারা এমপি মন্ত্রী হয়ে মুরব্বি ত্যাগী নেতাকর্মীদের অপদস্ত অসম্মান করতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যাবহার করেছেন – সেসব অহংকারী নেতারা আজ কই? তারা ভালো সৎ আদর্শবান হলে কেন জনগন তাদের পক্ষে হয়ে কথা বলছেন না।
১৯৯৬ সালের আগে কয়জন আওয়ামী লীগের মানুষ – রাঙুনিয়ার হাসান মাহমুদের নাম শুনেছে? সে কখনো দলের জন্য একদিন জেল খেটেছে না রাজপথে ছিলো? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন রাজনীতি করে বেলজিয়ামে উচ্চ শিক্ষার সুবাদে ওখানে নেত্রীর পরিচিতি কাজে লাগিয়ে এই মহা চাটুকার দলের শীর্ষ নীতিনির্ধারকের একজন বনে গিয়েছিলেন – সে ও তার ভাই আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে হেন অপরাধ নাই করে নাই, হাজার কোটি টাকা লুট করার পর – তাদের সরকারী বন, গরীবের খাস জমি দখল করে। কি ও কোন উদ্দেশ্য? কি কানেকসনে সে বারবার এমপি মন্ত্রী হলো, দুবাই সহ বিশ্বের তামাম শহরে এই লুটেরার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। এই দল যাকে নিয়ে আমরা সংগ্রামী ঐতিহ্যে- মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব নিয়ে অহংকার করি – সেখানে এই পাপীদের কারা আনলো তা আজ বড় প্রশ্ন।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া লোহাগড়া যে অঞ্চলটা সবসময় জামাতের দুর্ভেদ্য ঘাটি ছিলো – সেখানে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে স্কুল লেভেল থেকে ছাত্রলীগ করে জাতীয় নেতৃত্বে আসা আমিনুল ইসলামদের মনোনয়ন না দিয়ে – জামাত বান্ধব নদভী – নব্য ধনী মোতালেবদের বারবার মনোনয়ন দিয়ে – বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সংগঠনকে বিস্তৃত না করে, ব্যাক্তিকে established করা হয়েছিলো।
দলের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করার সুযোগ থাকলেও, হিংসা রেষারেষির কারনে আমিন ভাই, মাইনু ভাই দের সাইডলাইনে রাখা হয়েছিলো। যার ফল ৫ই আগষ্টের পর সাতকানিয়া লোহাগড়ার রাজনৈতিক মাঠ আজ আওয়ামী লীগ কর্মী শূন্য। টাকা দিয়ে বা টাকা খেয়ে বা আরেকজনকে দমাতে গিয়ে যারা এসব অপকর্মে লিপ্ত ছিলো, তারা শেখ হাসিনার বা দলের সুহৃদ ছিলো -বলে মনে হয় না।
সীতাকুণ্ডে একজন ত্যাগী পুরানো আওয়ামীলীগারের খবরও কি দলের কাছে ছিল না – সাবেক ডিগবাজি মেয়র মনজুর ভাইপো – বিএনপি নেতা দিদারকে এমপি বানানো হয়েছিলো, জনশ্রুতি আছে সে নাকি দলের প্রাথমিক সদস্য ফরম পূরন না করেই এমপি টিকেট নেন – দলকে কি এক তামাশায় পরিনত করছিল কাদের গং।
নাট্য পোলা, প্রমোদ বালক- ফেরদৌস, আরাফাত, রিয়াজ – খেলোয়াড় মাশরাফী, সাকিব, জয়, যাত্রা পালার অশ্লীল গায়িকা মমতাজরা আদৌ কি আওয়ামী লীগের মতো একটি সংগ্রামী দলে আসার যোগ্য? “খেলা হবে” জাতীয় কথা কি আওয়ামী লীগের মতো সমৃদ্ধ দলের সাধারণ সম্পাদকের মুখের ভাষা হতে পারে!!
যারা মনে করে ৫ই আগষ্ট আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে তারা মুলত বোকার স্বর্গে বাস করছেন — যেদিন যাদের কুবুদ্ধি ও পরামর্শে ২০১৮ সালে মধ্য রাতে ভোট হলো, সেদিনই আওয়ামিলীগ তার পতনের দিকে ধাবিত হয়, যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এদেশে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয় তার হাতেই ভোটের অধিকার ধর্ষন করা – এ প্রজন্ম মেনে নেয়নি।
১৯৭৫ সালের দলের দুঃসময়ে জেলখাটা ঝুঁকি নেওয়া – নোমান আল মাহমুদকে নমিনেশন দিয়েও কৌশলে তাকে ঘুরিয়ে দিয়ে – ২০০৫ সালের পর দলে যোগ দেওয়া জনৈক শিল্পপতিকে এমপি করে আনা হয় এবারের নির্বাচনে – যিনি দলের দুসময়ে না থেকেও টানা ১০ বছর সিডিএ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এসব দেখে শুনে মনে হতো – দলে প্রবীন সৎ ঐতিহ্য সমৃদ্ধ নেতাদের অপমান অসম্মান করতে ইচ্ছে করেই এসব করা হয়, এসবের পেছনে থাকতো গণভবনে টাকা খাওয়া চাকরবাকররা আর গুটিকতক দূর্নীতিবাজ অসৎ নেতা।
রাউজানে সালাউদ্দিন কাদেরর দোসর শহীদ ছাত্রলীগ নেতা বাবর মুজিব হত্যাকারী ফজলে করিম এমপি বঙ্গবন্ধু – শেখ হাসিনা থেকেও নিজেকে বড় মনে করতেন। পারিবারিক মেজবান, মুসলমানিতে তার অনুমতি নিতে হতো। সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে গিয়ে আওয়ামী লীগ করা লোক দেবাশীষ পালিতের মতো ত্যাগী শত শত নেতা রাউজনে যেতে পারতো না তার ভয়ে – রাউজানে নির্বাচন প্রথা উঠিয়ে দিয়েছিলেন এই ফজল করিম ।
সেখানে উপজেলা চেয়ারম্যান মেয়র ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এমনকি মেম্বার ও বিনা ভোটে হতো – সে সিলেকসন করতো কে মেম্বার কে চৌকিদার হবে। দলের সহযোদ্ধাদের হত্যাকারী নিজ দলের এমপি এই দুঃখে রাউজানে অনেক আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেছে। অথচ আজ রাউজানে এই ৪/৫ বারের এই এমপির কথা একটা গাছের পাতাও বলেনা – এলাকার সবখানে শুধু ঘৃনা তার জন্য।
আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রকৃত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কখনো এসব অন্যায় – অপকর্মের দায় নিতে পারিনা, পারবো না।
বর্তমানে গণহারে আওয়ামী লীগের সবাইকে অপকর্মের ভাগীদার করা অন্যায়। দুষ্ট, নষ্ট, ভ্রষ্ট রাজনীতির সাথে যারা জড়িত ছিল তারা মনেপ্রাণে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিশ্বাসী ছিল না – চাটুকারিতা মোসাহেবী করে কেউ পরিবারতন্ত্র আবার কেউ অবৈধ কালোটাকা দিয়ে – দলের সাময়িক নেতৃত্ব বাগিয়েছিলো। তারা এমপি মন্ত্রী হলেও – বর্তমানে এদের কেউ মাঠে নাই – এককথায় পলাতক। এলাকার জনগন, নেতাকর্মীদের বিপদে এলে ফেলে পালিয়েছে।
আজকে এই বৃহৎ সংগঠনের লাখো কর্মীরা সারাদেশে বিপদগ্রস্ত, আতংকিত, মিথ্যা মামলায় জর্জরিত – নিরীহ নেতাকর্মীদের বাসাবাড়িতে হামলা হচ্ছে, নির্যাতন করা হচ্ছে। আমরা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অনেকেই দলের পদপদবীতে না থাকলেও – স্বীয় রাজনৈতিক বিশ্বাস ধারন করে দুঃখ কষ্ট অভাবেও আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছি।
আজ এমপি মন্ত্রী যারা মাখন খেয়ে পালিয়েছেন – মুলত এই নব্য আগন্তুকরা ক্ষমতার রঙমহলে বেশীরভাগ আবির্ভূত হয়েছিলেন নোংরা ও কুটিল পথে – সেকারণেই আজ আওয়ামী লীগের চরম বিপর্যয়।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়ী, ভাস্করয, তার স্মৃতি সম্মান আজ নষ্ট হয়েছে আমাদের শীর্ষ নেতৃত্বের অযোগ্যতার কারনেই।
আজ মাঠে ৩০০ এমপি, অর্ধ শতাধিক মন্ত্রী, শতাধিক ( স্বঘোষিত) জাতীয় নেতা, গণভবনে সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে তোষামোদিতে ব্যস্ত রাখা তথাকথিত লুটেরা পারসোনাল স্টাফ নামধারী চাকরবাকররা আজ সব পলাতক। এই গুটিকয়েক অধঃ পতিত রাজনৈতিক দুষ্ট চক্রের অপরাধের দায়ভার – সারাদেশের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর বর্তানো অমানবিক, অযৌক্তিক।
গড়পড়তা সকলকে দোষারোপ করা, মিথ্যামামলায় অভিযুক্ত করা ভালো দৃষ্টান্ত নয়। অপরাধীদের বিচার করা হউক আমরা চাই – তবে তথ্য প্রমান থাকা বাঞ্চনীয়।
আমরা যারা আওয়ামী লীগ করি, করেছি এবং করবো – তাদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা বিশ্বাস করেই আওয়ামী লীগ করেছি।
যারা দেশসেবার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সৃষ্টির সেরা জীব “মানুষ” এর অনিষ্ট করেছে – প্রিয় মাতৃভূমি “বাংলাদেশ” কে লুঠপাট করে প্রতিনিয়ত ধর্ষন করেছে তারা আমাদের আদর্শিক সহযোদ্ধা নয়।
আমরা তাদের অপকর্মের দায়ভার মাথায় নিতে পারিনা। আওয়ামী লীগ আমাদের কাছে একটা অনুভূতি, আবেগের নাম।
দেশটা আমাদের সবার – দূর্নীতিবাজ, লুটেরাদের ছাড়া। আসুন সবাই সবাইকে সম্মান করি, বিনা অভিযোগ অপরাধে অন্যের অপকর্মে – একে অপরকে কষ্ট না দেই।
আওয়ামী লীগ করার অপরাধে – অসহায় নীরিহ নেতাকর্মীদের হয়রানি নির্যাতন করা উচিত হবে না।
আমরা সবাই একদিন দুনিয়া ছেড়ে আল্লাহর কাছে চলে যাবো — বাংলাদেশ থাকবে, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম এদেশকে গড়ে তুলবে। হিংসা হানাহানি না করে আসুন আমরা সকলে মিলে দেশ গড়ি। প্রকৃত অপরাধীদের বিচার করি। জয় বাংলা – জয় বঙ্গবন্ধু।